Friday, November 2, 2012

তানিয়াদের সকাল

স্বামীকে বিদায় জানিয়ে দরজাটি বন্ধ করার পর মুহূর্তেই অভিমান আর বিষণ্নতায় পেয়ে বসলো তানিয়াকে তানিয়া আহমেদ সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট স্বামী পারভেজ আহমেদ ব্যাংকার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে নিউক্লিয়াস পরিবার - সঙ্গে ভাইবোন মাবাবা কেউ নেই সকলেই গ্রামে বা অন্য শহরে

পৌরফোনে তানিয়ার চাকরির দশ বছর পূর্ণ হলো আজ সহকর্মীরা আজ তাকে নিয়ে কী কী করতো, কে কী ভাষায় অভিনন্দন জানাতো তা- ভাবছেন তানিয়া, আর বাসন মাঝছেন জানালায় আকাশ দেখছেন আনমনে কতকিছুই না মনে পড়ছে তার আজ! পৌরফোনে চাকরিটা হবে যখন বুঝতে পারলেন, তখন থেকেই তিনি বুঝতে পারলেন যে চাকরিটা তার করা হবে না চাকুরির ইন্টারভিউতে নিয়োগকারীই সাধারণত প্রশ্ন করে, শর্ত দেয় - তানিয়ার বেলায় ছিলো তার উল্টো ছুটি হবে কি না, মা হতে পারবেন কিনা, যাতায়াতের জন্য ট্রান্সপোর্ট হবে কি না ইত্যাদি প্রশ্নকারীরা বিস্মিত হলেও উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন, কারণ তানিয়ার স্পষ্টবাদিতা তাদের পছন্দ হয়েছিলো তারা মজাই পাচ্ছিলেন বেতন ভাতা ইনক্রিমেন্ট প্রমোশন ইত্যাদি বিষয়ে কোন আগ্রহই নেই তানিয়ার তার আগ্রহ ছিলো কাজটি কেমন হবে, সেটা করতে পারবেন কিনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিলো অফিস তার যাতায়াতের ব্যবস্থা করবে কি না খুশিতে কাঁদতেছিলেন তানিয়া ইন্টারভিউ রুমেই কারণ চাকরিটা তার হয়েই গেলো এবং তা তখনকার বাজারে বেশ মোটা-বেতনের চাকরিই বলা যায় স্বামী তো খুশি এবং বিস্মিতও; যেন এই প্রথম পারভেজ বুঝতে পারলেন যে স্ত্রীরা স্বামীর চেয়ে বেশি বেতন পেলে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয় চাকরি করার আনন্দ আর না করতে পারার আশংকায় হাবুডুবু তানিয়া বেতনের পরিমাণ নিয়ে কখনও ভাবেন নি

আজ দশম বছরে তানিয়াকে জানালায় তাকিয়ে কাঁদতে হচ্ছে চাকরিটা আছে বলেই হয়তো তানিয়াকে কাঁদতে হচ্ছে অথচ প্রতিবারই তানিয়া অফিস থেকে একটি লাল চিঠির আশংকা করেন এভাবে কতদিন সে অফিসকে ঠকাবে? এভাবে কতদিন শুনতে হবে মেয়েরা ফাঁকিবাজ, যখনতখন অফিসে অনুপস্থিত থাকে? সিনিয়র সহকর্মীরা তাকে বড্ড ভালোবাসে, তাকে বুঝার চেষ্টা করে এবং সহমর্মীতা দেখায় কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সমপর্যায়ের সহকর্মীদের নিয়ে, যাদের নিয়োগ হয়েছে তারই সময়ে, তারা টিজিং করেই যাচ্ছে

অমিতের জন্মের পর নির্ধারিত মাতৃ-ছুটির পরও তানিয়াকে একমাস বেশি ছুটি নিতে হয়েছিলো এক সহকর্মী তো বলেই ফেললো,  “বাব্বা! এতদিন পরও চাকরি থাকে! পরজনমে যেন নারী হয়ে জন্ম নেই, খোদার কাছে আমার এই প্রার্থনা!”

আরেক সহকর্মী তার চিরাচরিত শার্লকহোমস-টাইপের প্রশ্ন নিয়ে সেদিন চায়ের আড্ডাটিকে মাটি করে দিয়েছিলোআচ্ছা, এত অনুপস্থিত থাকার পরও আপনি এবার প্রমোশন পেলেন কী করে? বসও তো আপনাকে নিয়ে কোন কটুকথা বলতে শুনি নি!” তানিয়া এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না ছেলেরা ভালো করলে কোন প্রশ্ন নেই, সেটা স্বাভাবিকভাবে সকলে মেনে নেয়, কিন্তু মেয়েরা কর্মস্থলে সুনাম অর্জন করলে সকলেই সন্দেহের চোখে তাকায় প্রতিষ্ঠানের জন্য এতো পরিশ্রম করেও তাকে নিরন্তর এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। 

হঠাৎ অমিতেরআম্মু ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন তানিয়া অমিত ঘুম থেকে ওঠেছে বাবার ভক্ত হলেও অমিত আজ মাকে বাসায় পেয়ে বেজায় খুশিজাহানারা খালা আসে নি কেন, আম্মু?” তানিয়া তার কী উত্তর দেবে? জাহানারা আসে বেড়িবাঁধের বস্তি থেকে বিধবা জাহানারা গত দুতিন মাস ধরে তানিয়াদেরকে সাহায্য করছে তার প্রধান কাজ অমিতকে দেখাশুনা করা ঠিক গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো যে কীভাবে জাহানারা টের পেয়ে যায় সেটা তানিয়া আজও বুঝতে পারেন নি যেদিন তানিয়ার অফিসে থাকার খুবই দরকার, ঠিক সেদিন জাহানারা আসে না!  “আম্মু আম্মু, আবার যদি খালা না আসে তাহলে আব্বুকে বলো আমার সাথে থাকতে তা কী করে হয়! জাহানারা না আসলে তো তানিয়াকেই বাসায় থাকতে হবে এই তো স্বাভাবিক অমিতকে বুকে জড়িয়ে তানিয়া  আরেকটি দিন অফিসের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করেন

No comments:

Post a Comment