Friday, November 30, 2012

টেক্সট মেসেজ সিনোপসিস




সাক্ষাৎ হলেই নীলা বলতো:
তোমাকে গতকাল অনেক মিস্ করেছি
ফোন দিয়েছিলাম, রিং হলো বারবার
কিন্তু তুমি ধরছো না, কেন ধরো নি?
তুমি কি আমাকে মিস্ করো নি? কেন ধরো নি?
তোমার সাথে আড়ি; কেন ধরো নি?
তুমি কি আমাকে মিস করো নি?
তোমাকে না পেয়ে টেক্সট করেছিলাম
বলেছিলাম, মিসিং ইউ...
অপেক্ষা করেছিলাম তোমার রিটার্ন টেক্সট-এর;
তুমি কি আমাকে মিস্ করো নি?

তারপর কেটে গেলো কিছু ঝঞ্ঝাটময় সময়
বিয়ে হলো আমাদের
গড়ে ওঠলো লাল-নীল সংসার।
নীলা হলো গৃহিনী, আমি হলাম চাকুরে।

তারপরও কিছুদিন চললো আমাদের
পরস্পরকে মিস্ করাকরি, টেক্সট করাকরি।
কাটিয়ে দিলাম আরও কিছু সংসার-বিক্ষুব্ধ সময়:
 
এবার শুধু আমারই
মিস্ করার পালা
এখন আমাকে মিস্ করে না নীলা
কল করে না, কলব্যাকও করে না।
কিন্তু টেক্সট করে,
 
আলু-পেঁয়াজ কিনে নেবার জন্য।

Tuesday, November 27, 2012

জীবনে কতটুকু স্বচ্ছ থাকলে মৃত্যুতে সক্রেটিসের মতো শান্ত থাকা যায়?

বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ডকে এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। পাঁচশ’ জুরির উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কী শাস্তি চান। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না তার আচরণ ছিলো স্বভাবসুলভ অনমনীয়। তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের প্রস্তাব করেন! উদ্বেগহীন সক্রেটিস প্রস্তাব করলেন যেন, প্রাইটেনিয়াম হলে (পাবলিক হল) তাকে নিয়ে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়, প্রথাগতভাবে যা করা হতো গ্রীসের বীরদের জন্য। তাতে জুরিরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং বিপক্ষের জুরি সংখ্যা হঠাৎই ২৮০ থেকে ২২০ এ ওঠে গেলো। বিচার নিয়ে ঠাট্টাকারী সক্রেটিসের জন্য কঠিন শাস্তির প্রস্তাব আসলো।

মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি নিয়ে সক্রেটিসের উদাসীনতার এখানেই শেষ নয়। শিষ্য আর বন্ধুরা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সক্রেটিসের জন্য মৃত্যুদণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত এক মাস পেরোলে মুক্ত রাখার আবেদন করেছিলেন। তাতে আদালত মুক্তিপণ হিসেবে ৩০০০ দ্রাকমা (রৌপ্যমুদ্রা) দাবী করে, কিন্তু সক্রেটিস মাত্র ১০০ দ্রাকমা দিতে রাজি হন। অতএব জেলেই থেকে গেলেন দণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিস। ওদিকে সময় হয়ে এলো হেমলক পানের।

সক্রেটিসের সময়ে শিষ্য, বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত জেলে আসতে পারতো এবং থাকতে পারতো। অবশ্য সাথে প্রহরীরাও থাকতো ছায়ার মতো।

মৃত্যুর দিনের সন্ধ্যাবেলার দৃশ্য। সক্রেটিস তার শিশুপুত্র মিনেজেনাস কে বললেন, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। অত্যন্ত হাসিখুশি এবং শান্ত সক্রেটিস। তাকে ঘিরে বসে আছেন তার ভক্ত শিষ্য ও বন্ধুরা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই তাদের গুরুর মৃত্যুর দৃশ্য মঞ্চায়িত হবে। সাক্ষী হতে হবে এক অনাকাঙিক্ষত মৃত্যুর। শিষ্যরা সকলেই হতাশা আর আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় আচ্ছন্ন আছেন। ওদিকে সক্রেটিস তার মৃত্যুর পরের পোশাক গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। তিনি পড়ে নিচ্ছেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পোশাক, কারণ তিনি চান না মৃত্যুর পর কেউ তার গায়ে হাত দিক। শিষ্য আর বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সময় আলাদা হয়ে পরিবারের সকলের সাথে কথা বলে নিলেন।

জেল কর্মকর্তা একটু সময় আগে শেষ বিদায় জানিয়ে গেলেন। তার দু’চোখ ছিলো অশ্রুতে পূর্ণ। তিনি বলে গেলেন যে, সক্রেটিস ছিলেন তার অভিজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠ আসামি, সবচেয়ে ভদ্র আর অসম্ভব সাহসী। কিছুক্ষণ পরই হেমলকের রসে পূর্ণ পাত্র নিয়ে প্রবেশ করলো জল্লাদ। তীব্র এই হেমলক হৃদপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছে নিমিষে শরীরকে অসাড় করে দেয়। জল্লাদ নিরাবেগ কণ্ঠে বললো, এই পাত্রে এক ফোঁটা হেমলকও যেন বাইরে না পড়ে! সবটুকু পান করতে হবে! সক্রেটিস জল্লাদকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন, একটি ফোঁটাও নষ্ট হবে না। তারপর তিনি কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন। রুদ্ধনিঃশ্বাসে সকলেই তাকিয়ে আছে সক্রেটিসের উদ্বেগহীন শান্ত মুখটির দিকে। মানসিকভাবে সকলেই অস্থির, একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া।

প্রার্থনা শেষ করে বিষের পাত্র তুলে নিলেন সত্তর বছরের সক্রেটিস। পান করে নিলেন সবটুকু হেমলক রস, এক নিঃশ্বাসে। বিকৃত মুখভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায় কেউ বিষ পান করছে, কিন্তু সক্রেটিসকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তার মুখ বিন্দুমাত্র বিকৃত হয় নি। জলপানের মতো পান করেছিলেন তিক্ত বিষ। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। একজন শিষ্য মৃগীরোগীর মতো কাতরাচ্ছিলেন। সক্রেটিস তাকে কোলে নিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে সুস্থ করলেন।

পাষণ্ড জল্লাদ এবার দিলো তার নিষ্ঠুরতম নির্দেশটি। জল্লাদ বললো, এবার সক্রেটিসকে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করতে হবে যেন বিষটুকু ভালোভাবে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শিউরে ওঠে শিষ্যরা না না ধ্বনিতে মুখর করে তুললো জেলকক্ষটি। ভাবলেশহীন সক্রেটিস তা-ই করলেন। নিজের জীবনের বিনিময়েও তিনি জল্লাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা দিতে চান। তিনি ওঠে পায়চারি করতে লাগলেন। একসময় নিস্তেজ হয়ে এলো তার পা যুগল। অসাড় হয়ে এলো তার বিশালাকৃতির শক্ত দেহখানি। নিজের হাতেই মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন তিনি। এবার সবাই শান্ত, একটি শব্দও নেই কারও মুখে। কিছুক্ষণ সবই নিশ্চুপ, শান্ত। 

হঠাৎ মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে সক্রেটিস বললেন, ক্রিটো, একটি মুরগি ধার নিয়েছিলাম আমাদের পরিবারের জন্য। মনে করে তা আসক্লিপিয়াসকে শোধ করে দিও। এই তার শেষ বাক্য, যেন শেষ মুহূর্তে নিজেই নিজের বিচার করছিলেন। তারপর সবকিছু আবারও নিশ্চুপ। আর কোন শব্দ হয়নি।



সক্রেটিসের মৃত্যুর সাক্ষী জেলকক্ষটির আজকের দৃশ্য।


সূত্র: প্লেটো’র ‘এপোলজি’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার’।

Saturday, November 17, 2012

মো ইয়ানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাহিত্য: ২০১২ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার


মো ইয়ান সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সবচেয়ে আলোচিত লেখক যিনি ১৯৮০ সাল থেকে অব্যাহতভাবে লিখে চলেছেন তার অগণিত ভক্ত-পাঠকের জন্য। একজন জনপ্রিয় লেখক, আমাদের হুমায়ূন আহমেদের মতো, যিনি ইতিহাস ও সমসাময়িকতাকে ধারণ করেছেন দক্ষ হাতে। সমসাময়িক লেখকদের তুলনায়, তার লেখাগুলো সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। রেড সরগাম তার প্রধান কীর্তি, যা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জাং ইমু বিখ্যাত হয়ে যান এবং অর্জন করেন ‘গোল্ডেন বেয়ারসহ’ অসংখ্য এওয়ার্ড। মো ইয়ান একজন প্রলিফিক রাইটার, মাত্র ৪২ দিনে তিনি লিখে ফেলেন ‘লাইফ এন্ড ডেথ আর ওয়্যারিং মি আউট’ উপন্যাসটি। ‘দ্য গারলিক ব্যালাডস’ কৃষকদের প্রতি সরকারের অন্যায় আচরণের ওপর একটি বাস্তব ঘটনা-ভিত্তিক উপন্যাস।

জন্ম ও জীবিকা
মাও জেদং-এর সময়ে শানদং প্রদেশের একটি কৃষক পরিবারে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী মো ইয়ানের জন্ম (১৯৫৫)।
চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পর্যন্ত মো ইয়ান লেখাপড়া চালিয়ে যান। ছেড়ে দেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। পরিবারের সাথে কৃষিকাজে যোগ দেন। তারপর পেট্রোলিয়াম কারখানায় কাজ। একসময় যোগ দেন চীনা পিপলস লিবারেশন আমিতে (১৯৭৬)।
তারপর সাহিত্য বিষয়ের শিক্ষক এবং বর্তমানে চীনা লেখক সমিতির উপ-সভাপতি।

সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় লেখক মো ইয়ানের জন্ম (১৯৮১)।
ওই সময়েই তার লেখক সত্ত্বার আবির্ভাব। লেখতেন ছোট গল্প আর উপন্যাস। জাপানী আগ্রাসনের ফলশ্রুতিতে, তার প্রথম জীবনের লেখাগুলো ইতিহাস-ভিত্তিক এবং অনেকটাই সরল উপস্থাপনা। আসল নাম গুয়ান মোয়ে হলেও ‘মো ইয়ান’ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন, যার অর্থ ‘কথা বলো না’।
একেই তো সৈনিক, তারমধ্যে কমিউনিস্ট সরকারের কর্তৃত্ব, তাহলে কথা বলার সুযোগ কই? সে বিবেচনায় মো ইয়ান বা কথা-বলো-না নামটি কিন্তু বেশ জুতসই একটি ছদ্মাবরণ। তবে চাইনিজ লেখকদের বায়োগ্রাফি দেখলে বুঝা যায়, সরকারী কর্মকতা থেকে লেখক হবার ব্যপারটি একটি মামুলি বিষয়।

১৯৮৪ সালে মো ইয়ান চীনা সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সাহিত্য একাডেমিতে শিক্ষকের পদ লাভ করেন এবং একই বছরে প্রকাশ করেন তার প্রথম উপন্যাস ‘আ ট্রান্সপারেন্ট র্যা ডিশ’। ১৯৯১ সালে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৮ সাল থেকেই তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে সজ্জিত হয়ে আসছেন, যদিও অধিকাংশই পূর্ব এশিয়ান। অবশেষে ২০১২ সালে লাভ করেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।

“মো ইয়ানের সাহিত্যে দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্ততবতাকে লোককাহিনী, ইতিহাস এবং সমসাময়িকতার সাথে যুক্ত করা হয়েছে।” নোবেল কমিটির ঘোষণায়, এই ছিলো মো ইয়ানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের আনুষ্ঠানিক যুক্তি। হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজম নিয়ে নিজেই একটু হ্যালুসিনেশনে পড়ে গিয়েছিলাম, এটা আবার কী! শেষের দিকে একটু আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।

মো ইয়ান কি নোবেল পুরস্কারের উপযুক্ত ছিলেন? এবিষয়ে বিবিসি’র ভাষ্য এরকম: তিনি নোবেল পুরস্কারের উপযুক্ত ছিলেন। মো ইয়ান দশকের পর দশক ধরে লিখে যাচ্ছেন। তার আছে অগণিত পাঠক-ভিত। তিনি মানবতাকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন তার লেখায়, যা নোবেল নির্বাচনী পরিষদের পছন্দ হয়েছে।



কী নিয়ে লেখেন

শানদং-এ মো ইয়ায়ের বাল্যস্মৃতি, নিজের একান্ত দেখা জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে মো ইয়ান লিখেছেন। জাপানের আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত সমাজের চিত্র তুলে ধরেন তার Hallucinatory Realism বা ‘দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্ততা’ সমৃদ্ধ লেখাগুলোতে। কমিউনিস্ট মতবাদের প্রতি অনুগত হয়েও মো ইয়ান ব্যঙ্গাত্মকভাবে সমালোচনা করেছেন চীনের এক-সন্তান নীতির। মূলত তিনি একজন স্যাটায়ার (বিদ্রুপ সাহিত্য) লেখক। তার ‘ফ্লাইস’ গল্পে সৈনিক জীবনের এক বিদ্রুপাত্মক চিত্র ফুটে ওঠে। অন্য দিকে তার লেখায় আছে লৌমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর জীবনের বর্ণনা, যা বাস্তবও বলা যায় না আবার অসম্ভবও বলা যায় না।

নিজের সমাজকে সরল বর্ণনায় লেখতে শুরু করেন আর এর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন অতিপ্রাকৃতিক আর যাদুমন্ত্রের সংমিশ্রণ। এভাবে কৌশলে সরকারি নীতি, আগ্রাসন ও সমসমায়িকতাকে ব্যঙ্গ করেছেন। ‘রেড সরগাম’-এর একটি উদ্ধৃতি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে আলোকিত করে দেয়: “গ্রামের ডাকাতটিও মহান বীরে পরিণত হতে পারে।



কী দ্বারা প্রভাবিত/ লেখার অনুপ্রেরণা

সাহিত্য-সমঝদারেরা মো ইয়ানকে ‘সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে অভিনব ও সৃজনশীল ঔপন্যাসিক’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি অতীত-বর্তমান, মৃত-জীবিত এবং ভালো-মন্দ নিয়ে বিচরণ করেছেন তার লেখায়। সৃষ্টি করেছেন হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজম বা দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতা এবং তার লেখার এ অভিনবত্ব দিয়ে মুগ্ধ করেছেন নোবেল কমিটিকে। কী ছিলো তার অনুপ্রেরণা?

রেড সরগাম-এর পটভূমি নিয়ে তার একটি কথা অনেক লেখকের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তা হলো, “আমি অনেক গল্প শুনেছি আমার এলাকায় যা মুখে মুখে প্রজন্ম প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে থাকতো।” এই একজন যাদুকরী কাহিনীকার, যার লেখা প্রকাশ হওয়া মাত্রই পাঠকের হাতে চলে যেতো, কোথায় পেতেন তার বিষয়?

পাশ্চাত্যদের একটি ধারণা ঠিকই। এশিয়ার সমগ্র সাহিত্য জুড়ে আছে ইতিহাস, ক্ষমতাগ্রহণ, আগ্রাসন আর ক্ষমতাহীনেরা। এ অঞ্চলের সাহিত্যে রাজনৈতিক প্রভাব অনিবার্য। যেমনটি ঘটেছে মো ইয়ানের সাহিত্যজুড়ে: চীনে জাপানের অন্যায্য অভিভাবকত্ব না থাকলে রেড সরগামের পটভূমি কোথা থেকে আসতো? লেখকদের রাজনীতিক কর্মী হতে বাধা নেই, কিন্তু প্রথমত লেখক হতে হবে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন।

মো ইয়ান বিশ্বসাহিত্যের একজন নিয়মিত পাঠক। ভিনদেশী সাহিত্য দ্বারা তিনি দারুনভাবে প্রভাবিত, বিশেষত পশ্চিমা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ। তিনি লু সানের সামাজিক বাস্তবতাবাদ এবং গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের যাদুকরী বাস্তবতাবাদ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন।



হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজম/ দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতা জিনিসটা কী?

হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজম বা দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে শেষ করছি লেখাটি। প্রাকৃতিক বর্ণনায় প্রাণবন্ত হলে দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতাই আমাদেরকে বেশি আকর্ষণ করে।

১) 1) The Oxford Companion to Twentieth Century Art (1981)-এর সংজ্ঞা অনুসারে দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতা হলো:
“a careful and precise delineation of detail, yet a realism which does not depict an external reality since the subjects realistically depicted belong to the realm of dream or fantasy”

‘দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতা’ হলো বিস্তারিত বিষয়ের সুনির্দিষ্ট এবং সূক্ষ্ম বর্ণনা; এটি এমন এক বাস্তবতা যা বাইরের কোন বিষয়কে বর্ণনা না করে স্বপ্ন বা কল্পনাপ্রসূত বিষয়কে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরে।

২) Burkhardt Lindner এর মতে দৃষ্টিবিভ্রমকারী বাস্তবতা হলো:
“the attempt to make the bygone present with a documentary factuality and at an Aesthetic enhancement of the reality”

বাস্তবতার নান্দনিক বিস্তৃতির মাধ্যমে কোন অতিক্রান্ত বর্তমানকে দালিলিক বাস্তবতা দিয়ে উপস্তাপনা করার প্রচেষ্টাকে ‘হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজম’ বলে।



কাল্পনিক ও বিমূর্ত বিষয়কে বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োগ করা হয় হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজমের। জঁ টমি, কেবিন বেইকার এবং পিটার ক্যারি প্রমুখ লেখক হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজমের প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু তাদের লেখা বিভিন্ন কারণে একই মাপকাঠিতে বিবেচনা করা যায় না। অতএব এখন মো ইয়ানের নামই হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিজমের সাথে একাকার ও সমার্থক হয়ে গেলো, অনেকটা অফিশিয়ালভাবেই!




*২০১২ এর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে পূর্বতন পোস্ট। পরবর্তী কোন পোস্টে মো ইয়ানের দু’একটি সাহিত্য কর্ম নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে।

**তথ্যসূত্র:
ক) জেফরি কিংক্লি’র ওয়ার্ল্ড লিটারেচার ইন রিভিউ, খ) বিবিসি ও উইকিপিডিয়া, গ) চীনা ও বাংলা পত্রিকা এবং ঘ) ব্যক্তিগত অনুসন্ধান।

Tuesday, November 13, 2012

মো ইয়ান কি সত্যিই নোবেল বিজয়ী প্রথম চীনা নাগরিক?



বলুন তো, কোন দেশের নোবেল প্রাইজ বিজয়ী এখন জেলের ভাত খাচ্ছেন এবং স্ত্রী গৃহবন্দী? উত্তর হলো চীন। কোন্ দেশের নোবেল বিজয়ী স্বদেশ থেকে বিতাড়িত? উত্তর হলো চীন। কোন্ দেশের নোবেল প্রাইজ বিজয়ী দেশের শত্রু হিসেবে বিবেচিত? উত্তর হলো চীন। চীনা বংশোদ্ভূত তিন ব্যক্তি নোবেল প্রাইজ পেয়েও কোন্ দেশ তা স্বীকার করে না? উত্তর হলো চীন। এসবই হলো ২০১১ এবং এর পূর্ব পর্যন্ত চীনের নোবেল প্রাইজের খবর। ২০১২ সাল সম্পূর্ণ উল্টো। সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়ে চীনের সরকারসহ সমগ্র দেশ উত্তেজনায় উন্মক্ত। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন কিষাণের ছেলে মো ইয়ান, যার আসল নাম গুয়ান মোয়ে।
সবাই বিস্মিত, এমন কি পুরস্কার বিজয়ী মো ইয়ান নিজেও। “আমি উল্লাসিত এবং আতংকিতও। এ প্রাইজের তেমন তাৎপর্য আছে বলে আমার মনে হয় না, যেহেতু স্বীকৃতি পাবার মতো আরও প্রতিভাবান লেখক চীনে আছেন।” বললেন মো ইয়ান কারণ, ইতিমধ্যেই পশ্চিমে এ পুরস্কার নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। চীনে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল টাইম্স’ এর সম্পাদক তো বলেই দিলেন: “তার মানে বুঝতে হবে, চীন ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে।” পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বললেন, “এ পুরস্কার হলো চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও উন্নয়নের অনিবার্য সুফল।” দেখুন উত্তেজনার নমুনা। তো পূর্বের নোবেল প্রাইজগুলো কিসের সুফল ছিলো?
রাষ্ট্রীয় সকল প্রচার মাধ্যমে পূর্বের সকল নোবেল বিজয়ীকে সযত্নে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। নোবেল প্রাইজ বিজয়ের তিক্ত ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়ার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হলো: “মো ইয়ান কি চীনের প্রথম নোবেল বিজয়ী হতে পারে?”
এবার শুনাচ্ছি ২০১১ সাল পর্যন্ত চীনের নোবেল প্রাইজ অবজ্ঞা করার কাহিনী। ১৯৮৯ সালে ধর্মীয় গুরু দালাই লামা অর্জন করেন শান্তিতে নোবেল প্রাইজ। তিব্বতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দালাই লামা নেতৃত্ব দেয়ায় সেটাকে চীনা সরকার স্বীকৃতি দেয় নি। এ হলো চীনের প্রথম নোবেল প্রাইজ বিজয়ের কথা।
চীন বংশোদ্ভূত গাও জিংজিয়ান ২০০০ সালে সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। কিন্তু হায় তিনি তখন ফ্রান্সের ইমিগ্রান্ট! তার ‘সউল মাউন্টেন’ নামের উপন্যাসটিতে চীনের কনিউনিস্ট সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়। সুতরাং সেটা ব্যান করো! তাই হলো।

সবশেষ ২০১১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার, যা দেওয়া হলো চীনের মানবাধিকার কর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী লেখা লিউ জিয়াবাওকে। আর যায় কই, তাকে চিহ্নিত করা হলো রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসেবে। এবার বুঝেন তার গন্তব্য কোথায় হবে?
এভাবে চীন জাতীয়ভাবে দু’বার নোবেল পেলেও, কমিউনিস্ট সরকারের বিরোধী হবার কারণে তাদের কেউই স্বীকৃতি পান নি। ২০০০ সালের নোবেল বিজয়ী ফ্রান্সের অভিবাসী হবার কারণে তাকে এমনিতেই হিসেব থেকে বাইরে রাখা হলো।


তাহলে স্বীকৃতি পেলেন কে? মো ইয়ান, ২০১২ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। মো ইয়ান-এর বর্তমান পরিচিতি কী? চীনা লেখক সংগঠনের সহ-সভাপতি এবং ধারণা করা হয় যে তিনি ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্যও। তিনি চীনা জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির সাহিত্য বিষয়ের ডীনও।
মো ইয়ানের প্রতিভা নিয়ে আপাতত কিছুই বলছি না, বলছি নোবেল প্রাইজের রাজনীতিকরণ নিয়ে। পত্রিকা প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক, নোবেল প্রাইজের বিজয়ী নির্বাচনের আগে ও পরে হয় অনেক রাজনীতি, অথবা রাজায় রাজায় পীরিতি। দালাইলামা আর লিউ জিয়াবাওকে নোবেল প্রাইজ দিয়ে যেভাবে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল হালের পরাশক্তি চীনকে, সেই অবস্থার দ্রুত প্রশমনের জন্য দরকার হয়ে পড়েছিলো আরেকটি নোবেল প্রাইজের। নিজেদের অগ্রগতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে সমর্থন পাবার জন্য, এ নোবেল প্রাইজ পেতে চীনা সরকারও বিগত কয়েক বছর ধরে মরিয়া ছিলো।
রেড সরগাম-খ্যাত মো ইয়ানের উত্থান ও তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাহিত্য নিয়ে পরবর্তী কোন পোস্টে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

Friday, November 9, 2012

নিরাকার কারিগরের নিঃশব্দ ডাক


দিগন্তজুড়া মাঠ আর আদিম অরণ্য
শ্বেতচূড়ার পর্বত আর উপত্যকা অনন্য
পুষ্পময় তৃণভূমি তরঙ্গময় সমুদ্র
উড্ডয়নশীল ছাতক উল্লম্ব ঝরণাধারা -

স্তম্ভিত করে থামিয়ে দেয়
দৈনন্দিন জীবনের আবেশ থেকে
নামিয়ে দেয় এক
নিমগ্ন ধ্যানের গুপ্ত গুহায়

সৃষ্টির বিস্ময় নিরাকার কারিগরের দিকে
দৃষ্টি নিয়ে যায়
প্রকৃতির মায়াবী মোহনীয়তায় প্রকৃত গন্তব্যের
ডাক পাওয়া যায়

Thursday, November 8, 2012

একই সত্ত্বার একাধিক স্বরূপ হই নি কখনো সচেতন


পিঁপড়ের কাছে দৈত্য আমি, পর্বতের কাছে তুচ্ছ
মানবের কাছে অধরা আমি, ঈশ্বরের কাছে স্বচ্ছ

দৈত্য হয়ে বুঝি নি আমি, তুচ্ছ পিঁপড়ের শিক্ষা
ঈশ্বরের চোখে স্বচ্ছ হয়েও, মানবেরে করেছি উপেক্ষা

একই সত্ত্বার একাধিক স্বরূপ, হই নি কখনো সচেতন
দিতে চাই নি, নিতে শুধু চেয়েছি, আপন স্বার্থে সদা অচেতন

Wednesday, November 7, 2012

বারাক ওবামার জয়: তবে তো ঘূর্ণিঝড়ই ভালো!



তবে তো ঘূর্ণিঝড়ই ভালো! যুক্তরাষ্ট্রও জয়বায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পড়বে এবং প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী। এরকম কথা বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ প্রেজিডেন্ট ওবামা, আর তা-ই সত্য হলো। বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরকে তচনচ করে দিয়ে গেলো। তাতে ওবামা প্রশাসন নির্বাচনের সকল প্রচারণা স্থগিত করে দিয়ে নেমে পড়লেন দুর্যোগ মোকাবেলায়। একদিকে দুর্যোগ সম্পর্কে ওবামার ভবিষ্যৎ বাণীর সত্যতা অন্যদিকে ত্বরিৎ দুর্যোগ প্রশমনে সফলতা – এ দুটি ডাবল কৃতীত্বের তাৎক্ষণিক সুফল পেলেন র্বারাক ওবামা!  অথচ নির্বাচনের দিন সকালেও কেউ ধারণা করতে পারে নি সাদাঘরে আসলে কে যাচ্ছে। এ অনিশ্চয়তার অন্যতম প্রমাণ হলো জরিপের ৪৯:৪৯ সমীকরণ।

একথা সত্যি যে, নারী  এবং পিছিয়ে-পড়া ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য ওবামার দরদী হৃদয় ও অনুকূল পুনর্বাসন কর্মসূচি অনেকখানি তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে।

দ্বিতীয় মেয়াদে বিজয়ী ওবামা কণ্ঠে ছিলো কোন উচ্ছ্বাস, ছিলো না কোন অতিরিক্ত উত্তেজনা। “This has happened because of you. Thank you! … এ ফলাফলে আমি বিস্মিত নই ….দ্য বেস্ট ইজ ইয়েট টু কাম ফর অ্যামেরিকা! আমাদের পারস্পরিক মতভেদের মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ আছি এজন্য যে অ্যামেরিকার জন্য আমাদের আছে আশা।” যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও উত্তম অপেক্ষা করছে। ওবামা কথা দিলেন তার প্রতিপক্ষ রমনিকে নিয়ে একসাথেই কাজ করবেন।

ওদিকে মিট রমনি তাৎক্ষণিক সমাবেশে অভিনন্দন জানালেন পুনঃনির্বাচিত প্রেজিডেন্টকে। “চেয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রকে অন্য একটি দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে…কিন্তু আপনারা যেহেতু অন্য একজন নেতাকে পছন্দ করেছেন…এখন আপনাদের সাথেই তার জন্য আকুলভাবে প্রার্থনা করি। আর প্রার্থনা করি এই মহান জাতির জন্য।”  সামনের সারির হতাশ সমর্থকদের চোখে পানি থাকলেও রমনির স্বাভাবিক আচরণ।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সত্যিই মুগ্ধ করে আমাদের।  আমরা মোহিত হই, আপ্লুত হই, ইউটোপিয়ান স্বপ্ন দেখি। আমাদের কাজই শুধু মুগ্ধ হওয়া আর অন্যের জয়ে অভিনন্দন জানানো। আহেম! আমাদের নেতানেত্রীরা যথাসময়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন চিকন কালা ভাইকে!

ওবামা বা রমনির জয়-পরাজয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছুই যায় আসে না। তাদের বিদেশ-নীতিতে একচুল এদিক-সেদিক হয় না: ডেমোক্রাট বলেন আর রিপাবলিকান। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে রমনীর বিজয়ে একটু চিন্তিতই হতাম। হয়তো এর অন্যতম কারণ রিপাবলিকানদের রক্ষণশীল ও ইমিগ্রান্ট-বৈরি নীতির জন্য। তাছাড়া আরেকটা আফগানিস্তান বা আরেকটা ইরাকের ঘটনা যে ঘটতো না, তা কে জানে! শ্বেতাঙ্গ না হবার কারণে একটা মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্য অনুভব করি আমি ওবামার প্রতি।